কাহ্নপাদ ও ভুসুকপাদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর

0

সাধক কবি কাহ্নপাদ এবং ভুসুকুপাদ একই সময়ের কিনা এ বিষয়ে মতান্তর রয়েছে । তবে সাধন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এবং দার্শনিকতার ভিত্তিতে দুজনেই যে বৌদ্ধ মহাযান পন্থী ছিলেন তা অনুমান করা যায় । মহাযানী সম্প্রদায়ের মধ্যে আদর্শ ও সাধন প্রণালী নিয়ে উপদল তৈরী হয়েছিল । সিদ্ধাচার্যের বজ্রযান , মন্ত্রযান , কালযন্ত্রযান এবং সহজযান – এই চারটি প্রধান দলে বিভক্ত হন । 


কাহ্নপাদ ছিলেন সহজযানী । ভুসুকু সম্ভবত : বজ্রযান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন । তবে চর্যায় সংকলিত পদগুলিতে তাঁর সহজসাধনার কথা আছে কাহ্নপাদ যেমন আত্মোপলব্ধির সহজানন্দকে প্রধান স্থান দিয়েছেন , ভুসুকুপাদ তেমনি চিত্ত সংযমের বিরমানন্দকে মুখ্য করে তুলেছেন । সংসার আসক্তি বর্জন করে চিত্তকে অচিত্ততায় লীন করবার কথা তিনি বারংবার বলেছেন । 


বৌদ্ধ তন্ত্রমন্ত্রে চিত্ত প্রশান্তি অর্থাৎ তথতা থাকে নির্বাণ লাভ বা ভবচক্র থেকে অব্যাহতি বলা যায় তাই ছিল ভুসুকুর বক্তব্য । তাঁর মতবাদে কিছুটা বৌদ্ধ প্রভাব অনুমান করা যায় । অপরদিকে কাহ্নপাদ চিত্তে অদ্বয় তত্ত্বের উপলব্ধি সঞ্চারের দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন । 


ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্রের প্রাণায়ামে যোগের প্রক্রিয়ার কথা কাহ্নপাদের পদে আছে । এই যোগের উদ্দেশ্য “ চিত্তবৃত্তির্নিরোধঃ ” ষটচক্র ভেদের কথা , মহাসুখ চক্র বা কোনো তান্ত্রিক সহস্রবারের কথা কোন কোন পদে আছে । সহজযানী কাহ্নপাদের পদে হিন্দুতন্ত্রের প্রভাব বেশি বলে মনে হয় ।


কবিধর্মে ও কবিকর্মে কাহ্নপাদের সঙ্গে ভুসুকু পাদের কিছু পার্থক্য আছে । উভয়েই পারিভাষিক সন্ধ্যা শব্দ ব্যবহার করেছেন , উভয়েই গূঢ় রূপক ব্যবহারের কাব্য কৌশল অবলম্বন করেছেন । কিন্তু রূপক নির্বাচনে ব্যক্তিত্বের চিহ্ন আছে ।


তান্ত্রিক কপাল চৰ্যা পন্থী কাহ্নপাদ ডোমনারীর সঙ্গে কাপালিকের প্রণয় সম্পর্কের রূপক গ্রহণ করেছেন । কিন্তু একদা রাজা ও পরে সেনাপতি ভুসুকুপাদ হরিণ শিকার , আহেরি বৃত্তি , ডাকাতির সংঘাত , ইদুর হত্যা প্রভৃতি রূপক ব্যবহার করে কাব্যের কৌতুহল সৃষ্টি করেছেন ।


কবি কল্পনার দিক থেকে ভুসুকুর কিছু বিশিষ্টতা আছে । তিনি ভোগ সুখাগার পরিহার ও ত্যাগের তাৎপর্য বোঝানোর জন্য হরিণ হরিণীর গল্প বলেছেন । জগতের অলীকতার তত্ত্ব বলতে গিয়ে উদ্ভট অবাস্তব কল্পনার অনেকগুলি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন । নৌকা যাত্রায় নিষ্ঠুর ডাকাতের অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন । তাঁর কল্পনাশক্তি অবশ্যই প্রশংসনীয় । কিন্তু তাত্ত্বিক কবি দম্ভভরে বলেছেন “ মূঢ় হি অহি ণ পইসই ” ।


ভুসুকুর রচনায় তত্ত্ববোধের গভীরতা , কাহ্নের রচনায় জীবনবোধের সরসতা আলিকালি পথ রুদ্ধ করে কবিকে বিমনা করেছে । সেই তত্ত্বকথার মধ্যেও কবি কাহ্নের ব্যক্তিত্বের স্পর্শটুকু আছে । “ এবংকার দিঢ় বা খোড়ে মোড়িউ ” — কবির চিত্ত গজেন্দ্র ‘ এ ’ এবং ‘ বং ’ – শূন্যতা ও দৃঢ় বন্ধন মোচন করেছে । পরবর্তী পদটিতে ডোম নারীর সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক স্থাপনের একটি চমৎকার নাটকীয় দৃশ্যই গড়ে তুলেছেন । তত্ত্ব ব্যাখ্যায় লৌকিক প্রেমের রূপক চিত্র অঙ্কনে কাহ্নপাদের মত দক্ষ কবি সিদ্ধা চার্যদের মধ্যে আর দ্বিতীয় নেই ।


কাহ্নপাদের কয়েকটি কবিতা নিছক তত্ত্বকথা । কিন্তু আলঙ্কারিক কৌশল আছে । গুরু শিষ্যের সম্পর্ক বোঝানোর জন্য বোবা ও কালার প্রসঙ্গ । গাছের বর্ণনায় মনের সঙ্গে রূপক ঘটিয়ে সা রূপক সৃষ্টি । অপ্রস্তুত প্রশংসায় যেমন উদ্দিষ্ট অর্থকে গোপন রাখা হয় , কাহ্নের কোন কোন পদে সেই ভঙ্গি আছে । ভুসুকুও অজস্র রূপক ব্যবহারে কাব্য কলার বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন । 


কাহ্নের পদে তত্ত্ব নিরপেক্ষ মানবিক রসমূল্যের যে প্রকাশ ভুসুকুর পদে তা নেই । তত্ত্বকে ছেড়ে দিয়ে রূপকগুলি স্বতন্ত্র রসমূল্যে উদ্ভাসিত হয়না । তাঁর রচনার উপমান ও উপমেয় ঠিক সমান্তরাল রেখায় চলেনি । উভয়েই সাধক কবি । কিন্তু সাধকত্বে কবিত্বে কিঞ্চিৎ পরিমাণগত পার্থক্য আছে । ভুসুকুপাদে সাধকত্ব বেশি এবং কাহ্নপাদে কবিত্বের পরিমাণ অধিক ।

Post a Comment

0 Comments
Post a Comment (0)
To Top