দ্বাদশ শ্রেণীর সংস্কৃত আর্যাবর্তবর্ণনম বাংলা অনুবাদ

0


আর্যাবর্তবর্ণনম্ ( নলচম্পূঃ প্রথমোচ্ছ্বাসঃ )


বিষয়বস্তু


লেখক ত্রিবিক্রমভট্ট প্রাচীন ভারতের তথা আর্যাবর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন —  আর্যাবর্ত নামের দেশ সকল দেশের সেরা । এখানে সমস্ত পৃথিবীমণ্ডলের সৌন্দর্য একত্রিত হয়েছে । স্বর্গলোকের মতো সেবা বা সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য এখানে পাওয়া যায় । গ্রাম্য - কবিদের কথা কাব্যের সমান , নীরস লোকেরাও মনোহর , অথবা জল ও শস্যের দ্বারা দেশ শোভাযুক্ত । মহাভারত নামক কাব্য অথবা ভারতবর্ষের অলংকার স্বরূপ এই দেশ সকল দেশের অগ্রগণ্য — “ অগ্রণীঃ সর্ববিষয়াণাম্ । ” 



ব্যাকরণ না - পড়েও প্রকৃতি , প্রত্যয় , নিপাত , উপসর্গ , লোপ তথা বর্ণবিকারের দোষ দেখা যায় না । পক্ষান্তরে প্রজাদের মধ্যে পতন , উপদ্রব , লোপ তথা বর্ণ - ব্যবস্থার কোনো প্রকার বিকার দেখা যায় না এই দেশে । ভগবান শিবের জটাজুটের সমান বিকশিত পীত তথা নীলপদ্মের পরাগরেণু দ্বারা হলুদবর্ণে শোভিত হংসের মতো শোভাযুক্ত অত্যন্ত চঞ্চলতাযুক্ত চকোর , চক্রবাক , সারস ( হংস ) -দের দ্বারা শোভা পাচ্ছে নদীর তীরসমূহ । 



রাজা ভগীরথের কীর্তি - পতাকার দ্বারা তৈরি , স্বর্গে পৌঁছোনোর সিঁড়ির মতো গলির মধ্যে প্রবাহিত এমন স্রোতস্বিনী গঙ্গার জলের দ্বারা পবিত্র এই দেশ । এই পবিত্র গঙ্গাজলের এক অংশ চন্দ্রবংশকে উদ্ধার করেছে । এই জল নিখিল বিশ্বের তত্ত্বভূত , পুণ্যার্থীদের শরণাগত ( শরণ্যঃ পুণ্যকারিণাম ) । এই দেশ সুন্দর কদলীবনের উদ্যানের মতো শোভাযুক্ত । শুধু তাই নয় – এই দেশ ধর্মের আশ্রয়স্থল ( ধাম ধর্মস্য ) , সমস্ত সম্পদের কেন্দ্রস্থল কল্যাণের আশ্রয় , সৎপুরুষদের আচরণের রত্নভাণ্ডার । 



এই আর্যাবর্তে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মর্যাদা , তাঁদের শিক্ষণীয় উপদেশ দান সবই গুরুকুলের মাধ্যমে অর্থাৎ আশ্রমে গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা দেওয়া হয় । তাই ত্রিবিক্রমভট্ট বলেছেন —  আচার্যভবনমার্যমর্যাদোপদেশানামার্যাবর্তো নাম দেশঃ । ”


আর্যাবর্তে বসবাসকারী রোগমুক্ত প্রজাদের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে লেখক বলেছেন — এই দেশের প্রজারা নিরন্তর ধর্মকর্মের উপদেশ দ্বারা সবরকমের দৈহিক , দৈবিক ও ভৌতিক বিপদগুলি থেকে মুক্তি পায় । ফলে যতদিন তারা বেঁচে থাকে ততদিন রোগমুক্ত জীবনযাপন করে ।


বিপদ তিন প্রকারের – 

( ১ ) আধিদৈহিক : মানুষের শরীর সম্বন্ধীয় নানা রোগ । এটি ঔষধে নিরাময় সম্ভব । 

( ২ ) আধিদৈবিক : দেবতাকে অধিকার করে প্রবৃত্ত হয় , যা মানুষের অধীন নয় । যেমন বজ্রপাত , ভূমিকম্প প্রভৃতি । 

( ৩ ) আধিভৌতিক : ভূত বা হিংস্র জন্তু থেকে আগত বিপদ । বিষধর সাপ , বাঘ , সিংহ প্রভৃতি জন্তু থেকে আগত বিপদ থেকে আর্যাবর্তে বসবাসকারী সকল প্রজা মুক্ত ছিল – “ সমস্ত ব্যাধি ব্যতি করাঃ পুরুষায়ুষজীবিন্যঃ । ” 


সমস্ত প্রজা সুখে বাস করত । 

কারণ — 

( ১ ) সেদেশে কোনো প্রকার রোগ , বিশেষত কুষ্ঠ রোগ ছিল না । কোনো ওষুধের দোকান ছিল না । ছিল কেবল সুগন্ধি বিক্রির দোকান । 


( ২ ) শুধু স্ফোটবাদ অর্থাৎ শব্দ ব্রত্নবাদ ব্যাকরণের জ্ঞাতারাই জানেন । অন্যভাবে বলা যায় — সামান্য ব্যক্তিদের মধ্যে ফোড়া - ফুসকুড়ি ( রোগবিশেষ ) ছিল না । 


( ৩ ) তাল ( লয় - যতি - সংগীত ) -এ সন্নিপাত অর্থাৎ একসঙ্গে দুটো হাতে বাজানো হয় । — “ যস্যাং দক্ষিণহস্তেন তালং বামেন যোজয়েৎ । উভয়োর্হস্তয়োঃ পাতঃ সন্নিপাতঃ স উচ্যতে । ” কিন্তু প্রজাদের মধ্যে সন্নিপাত ( রোগবিশেষ ) ছিল না । 


( ৪ ) জ্যোতিঃশাস্ত্র বা গণনাশাস্ত্রগুলিতে সূর্য - চন্দ্রাদি - নক্ষত্রগণের সংক্রান্তি ছিল । আর্যাবর্তে বসবাসকারীদের মধ্যে কোনো সংক্রমণ বা ‘ গ্রহকলহ ’ ছিল না । কেউ গ্রহকলহে আক্রান্ত ছিল না । গ্রহকৃত দুর্দৈব ঘটনা বা রাহুকৃত পীড়ন বা রাহুগ্রাস ছিল না । 


( ৫ ) ভূতবিকারবাদ অর্থাৎ পৃথিবী , অপ ( জল ) , তেজ , বায়ু , আকাশ প্রভৃতি পঞ্চভূত তত্ত্বের বিকৃতি সাংখ্যদর্শনে ছিল । প্রাণীদের মধ্যে ভূত - প্রেতাদির উপদ্রব বা বিকার ছিল না । 


( ৬ ) ক্ষয় প্রতিপদাদি তিথিগুলিতেই থাকত , প্রজাদের মধ্যে ক্ষয়রোগ ছিল না । 


( ৭ ) গুল্ম - লতা বৃদ্ধি বনভূমিতেই ছিল । প্রাণীদের মধ্যে গুল্মরোগ ছিল না । গুল্মরোগ হল প্লিহারোগ । এই রোগের প্রতিষেধক হল আমলকী ।


( ৮ ) গল - গ্রহণ ( গলায় ফাঁস লাগানো ) মাছেদের মধ্যে ছিল । অন্য প্রজাদের মধ্যে গলায় ফাঁস লাগানোর ব্যাপার ছিল না ।


( ৯ ) গণ্ডক ( গন্ডার ) -এর উত্থান পর্বত ও বনে দেখা যায় । প্রজাদের মধ্যে ফোড়া গণ্ডস্থলে বের হত না । 


( ১০ ) শূল নামক অস্ত্র চণ্ডীদেবীর মন্দিরে দেখা যায় , কিন্তু কোনো প্রজার মধ্যে অম্লশূল নামক রোগ দেখা যেত না । এইসব কারণে আর্যাবর্ত স্বর্গের চেয়েও বড়ো ।



আর্যাবর্তের পরিবেশ , গ্রাম , নগর প্রভৃতি অত্যন্ত মনোরম । সেখানকার গ্রামগুলি অশ্ব দিয়ে সংগ্রামের মতো সুসজ্জিত থাকে । পাহাড়গুলি বনবেষ্টিত এবং হস্তিশাবকে পরিপূর্ণ । নগরগুলি উঁচু উঁচু অট্টালিকার দ্বারা , উত্তম আচরণের দ্বারা অর্থাৎ সবসময় পায়ে নূপুর দ্বারা শোভিত । সেখানে বসবাসকারী লোকজন সর্বদা আকাশে চলমান ঝড়ের মতো গতিশীল অথবা দান তথা ভোগযুক্ত লোকের সমাগম । 


আর্যাবর্তে অবস্থিত বনগুলি কান্তাদের কথোপকথনরূপী তত্ত্বস্বরূপ যৌবনের সমান প্রিয়াল এবং কাঁঠাল ফলযুক্ত । বিট বা লম্পট পুরুষদের দ্বারা ঘেরা সেবিকাদের মতো বাটিকা বা আবৃত স্থান । নিবৃত্তি বা সুখস্থানগুলি সুন্দর রমণী বা কলত্রের মতো সমান । আখের খেতে দানশালা আছে । সেখানে মানুষ তার রসনিবৃত্তি করে । রাবণের অনুচরেরা ক্রুদ্ধ বানরদের দ্বারা পীড়িত । কূপগুলি গভীর জলে পরিপূর্ণ । কুলবধূরা সাধ্বীদের ব্রত পালনের ফলে তাদের সমস্ত দোষ দূর হয়েছে এবং সূর্যের কিরণের মতো কান্তিযুক্ত হয়েছে ।


শুধু তাই নয় – গাছের শাখাগুলি - ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ বসন্ত ঋতুতে পল্লবহীন হয়ে গেলেও মানুষের মধ্যে কখনও বিপদের লেশমাত্র দেখা দিত না । 


আর্যাবর্তকে স্বর্গের চেয়ে বড়ো বলে মনে করা হয়েছে – “ কথং চাসৌ স্বর্গান্ন বিশিষ্যতে । ” আর্যাবর্তকে স্বর্গের থেকে বড়ো বলে মনে করার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে — 


( ১ ) আর্যাবর্তে বসবাসকারী ব্যক্তিগণ সর্বদা প্রসন্নচিত্ত থাকেন । স্থানটি শোভন রাজ্য হিসাবে বিবেচিত “ সৌরাজ্য - রঙ্কিত মনসঃ । ” অর্থাৎ উত্তম রাজ্য হওয়াতে সকলে আনন্দে থাকেন । 


( ২ ) উত্তম রাজ্য সকল প্রকার সমৃদ্ধির দ্বারা সমৃদ্ধ দেশ – “ সকল - সমৃদ্ধি বর্ধিতঃ । ” 


( ৩ ) এই দেশ মহোৎসবের পরম্পরা বা প্রথা মেনে চলে “ মহোৎসব পরম্পরারম্ভনির্ভরাঃ । ”


( ৪ ) উত্তমগুণযুক্ত ব্যক্তি সর্বদা অকুলীন অর্থাৎ কুলহীন পৃথিবীতে লীন থাকে না এমন দেবতাকে , অহংকারহীন ব্যক্তি দেবরথ প্রাপ্ত দেবতাকে , অনেক ধনশালী কিছু অল্পধনপ্রাপ্ত দেবতাকে উপহাস করেন । তাঁরা উপহাস করে বলেন আর্যাবর্ত কী কারণে স্বর্গের সমান বড়ো নয় , অর্থাৎ আর্যাবর্ত স্বর্গের থেকে সবদিক দিয়ে বড়ো ।


( ৫ ) স্বর্গে একমাত্র গৌরী ( উমা ) আছেন কিন্তু আর্যাবর্তের ঘরে ঘরে গৌরবর্ণা বা শুদ্ধ ভাবসম্পন্না নারী আছে । স্বর্গে একজন মহেশ্বর আছেন কিন্তু আর্যাবর্তের ঘরে ঘরে অতি সমৃদ্ধ মানুষ আছে । স্বর্গে একজন বিষ্ণু ( হরি ) আছেন , আর্যাবর্তের ঘরে ঘরে শোভাযুক্ত ঘোড়া আছে । স্বর্গে একজন কুবের ( ধনদ ) আছে কিন্তু আর্যাবর্তের স্থানে স্থানে ধনদাতা তথা লোকপাল / লোকরক্ষক আছে । তা ছাড়া , স্বর্গে দেবতাদের রাজা সুরাধিপ ইন্দ্ৰ আছেন , কিন্তু আর্যাবর্তে মদ্যপানকারী রাজা নেই । স্বর্গে একজন বিনায়ক ( গণেশ ) আছেন , কিন্তু আর্যাবর্তে রাজার বিরুদ্ধাচারী ( বি - নায়ক ) কেউ নেই । তাই আর্যাবর্ত স্বর্গের থেকেও বড়ো ।



কবি ত্রিবিক্রমভট্ট আরও বলেছেন যে , এই দেশ লোকের দ্বারা অনুক্রোশ যোজন যুক্ত বা দয়ার দ্বারা সমৃদ্ধ পুণ্যতম দেশ , যার উত্তর ভাগে ঊর্ধ্ব ( উচ্চ ) ভাগযুক্ত হিমালয় আছে । এরকম আর্যাবর্ত কার - ই - না প্রিয় হয় অর্থাৎ সকলের প্রিয় জন্মভূমি ।


সংস্কৃত ভাষায় অনুচ্ছেদ রচনা — ঋতুবৈচিত্র্যম্ , গ্রীষ্মকালঃ


আর্যাবর্তবর্ণনম বাংলা অনুবাদ মূলপাঠ ১ — মূলপাঠ ৫

Post a Comment

0 Comments
Post a Comment (0)
To Top